সংঘবদ্ধ মানব জীবনে ব্যবস্থাপনা এক অতি অপরিহার্য বিষয় । কতিপয় ব্যক্তি যখন কোনো সাধারণ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য একত্রিত হয় তখন তাদের সঠিকভাবে পরিচালনার প্রয়োজন পড়ে। সেখানে যদি কেউ পরিচালক না থাকেন, যদি কেউ নেতৃত্ব না দেন তবে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়াই স্বাভাবিক । আর এরূপ বিশৃঙ্খলা মানুষসহ সকল উপকরণের কার্যকর ব্যবহার অসম্ভব করে তোলে । তাই একদল মানুষকে তাদের লক্ষ্যপানে এগিয়ে নেয়ার কার্যকর প্রয়াস বা শক্তিই হলো ব্যবস্থাপনা । আর যে বা যারা এ প্রয়াস চালান তাদেরকে ব্যবস্থাপক, প্রশাসক, নির্বাহী, পরিচালক ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয় । এরূপ প্রয়াস শুধু ব্যবসায়ের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, সরকারি প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি সংস্থা ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তাই এরূপ প্রয়াস- প্রচেষ্টা সম্পর্কে সবারই সম্যক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন ।
১. ব্যবস্থাপনার ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারবে ।
২. ব্যবস্থাপনার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ বর্ণনা । করতে পারবে ।
৩. ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব বিশ্লেষণ করতে পারবে ।
৪. ব্যবস্থাপনার কার্যাবলি ব্যাখ্যা করতে পারবে
৫. ব্যবস্থাপনার আওতা সনাক্ত করতে পারবে ।
৬. ব্যবস্থাপনা চক্র বর্ণনা করতে পারবে ।
৭. ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন স্তর ব্যাখ্যা করতে পারবে ।
৮. পেশা হিসেবে ব্যবস্থাপনার অবস্থান বিশ্লেষণ করতে পারবে।
৯. ব্যবস্থাপনার সর্বজনীনতা বিশ্লেষণ করতে পারবে ।
কাজ
প্রক্রিয়া
পদ্ধতি
মাধ্যম
মিশরীয় সভ্যতা
ব্যবিলনীয় সভ্যতা
গ্রীক সভ্যতা
রোমান সভ্যতা
পরিকল্পনা
নির্দেশনা
সমন্বয়
নিয়ন্ত্রণ
জনাব হক ছোট ব্যবসায় দিয়ে শুরু করে এখন অনেক বড় ব্যবসায় গড়ে তুলেছেন । এখন অনেক মানুষ তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করে । কারখানায় নতুন নতুন মেশিন বসিয়েছেন । প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রতিটা মানুষ যাতে সর্বোচ্চ দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারে সেজন্য তিনি সদা সচেষ্ট থাকেন । তিনি কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও নানান সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের উৎসাহ ধরে রাখতে চেষ্টা করেন । প্রতিটা কাজ আগেই ঠিক করে সবাইকে বুঝিয়ে দেন । কাজের খোঁজ-খবর রাখেন ও ভুল হলে তা শুধরে দেন। এরপরও কাজে সমস্যা হলে তা সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করেন । তার এই চেষ্টা-প্রচেষ্টাই তাকে সফলতা দিয়েছে । তিনি একজন সফল ব্যবস্থাপক । এক্ষেত্রে লক্ষ্যার্জনে গৃহীত জনাব হকের সকল কর্মপ্রয়াস ব্যবস্থাপনা নামে পরিচিত ।
ব্যবস্থাপনা শব্দটি ইংরেজি 'Management' শব্দের প্রতিশব্দ । ইংরেজি 'Management' শব্দটির সমার্থক শব্দ গণ্য করা হয় ‘to handle'- অর্থাৎ চালনা করা বা পরিচালনা । ইংরেজি এ শব্দটি অধিকাংশের মতে ল্যাটিন বা ইতালীয় ‘Maneggiare' শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ হলো 'to trained up the horses'-অর্থাৎ অশ্বকে প্রশিক্ষিত করে তোলা বা পরিচালনার উপযোগী করে তোলা । যা কালের বিবর্তনে মানুষকে প্রশিক্ষিত করে তার নিকট থেকে কাজ আদায়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়ে পড়েছে ।
সহজ অর্থে, প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্যার্জনের জন্য এতে নিয়োজিত উপকরণাদির কার্যকর ব্যবহারের সকল প্রয়াস- প্রচেষ্টাকে ব্যবস্থাপনা বলে। এরূপ প্রয়াস-প্রচেষ্টার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে ব্যবস্থাপক বলা হয়ে থাকে । সঠিকভাবে সবকিছু চালাতে পারার উপরই উপকরণাদির কার্যকর ব্যবহার ও লক্ষ্যার্জন নির্ভর করে। একটা প্রতিষ্ঠানে দু'ধরনের উপকরণ থাকে; মানবীয় ও বস্তুগত । মানবীয় উপকরণ বলতে মানুষ বা জনশক্তিকে বুঝায়। আর বস্তুগত উপকরণ বলতে যন্ত্রপাতি, মালামাল, অর্থ, বাজার ও পদ্ধতিকে বুঝানো হয়ে থাকে এদেরকে সংক্ষেপে 6'M (Men, Machine, Materials, Money, Market ও Method) বলে। এ সকল উপকরণের কার্যকর ব্যবহার সম্ভব হলেই একটা প্রতিষ্ঠান তার কাঙ্খিত ফললাভ করতে পারে । তাই এদের কার্যকর ব্যবহারের জন্য ব্যবস্থাপকগণ প্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক ও সুশৃঙ্খল কর্মপ্রয়াস চালান। যাকে ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া নামে অভিহিত করা হয়। এরূপ প্রক্রিয়ার সাথে পরিকল্পনা, সংগঠন, কর্মীসংস্থান, নির্দেশনা, প্রেষণা, সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ কার্য সম্পৃক্ত । তাই প্রকৃত অর্থে, উপকরণাদির কার্যকর ব্যবহার করে লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য পরিকল্পনা, সংগঠন, কর্মীসংস্থান, নির্দেশনা, প্রেষণা, সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ কার্যকে ব্যবস্থাপনা বলা হয়ে থাকে । নিম্নে এ সংক্রান্ত একটা ধারণা চিত্র প্রদত্ত হলো:
কোনো বিষয় সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা লাভ করতে হলে তার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানা আবশ্যক । কারণ প্রকৃতি হলো কোনো বিষয়ের সাধারণ বৈশিষ্ট্য (General character)। অন্যদিকে বৈশিষ্ট্য হলো বিশেষভাবে নজরে পড়ে স্বতন্ত্রধর্মী এমন কিছু (Something especially noticeable)। পুরুষ ও নারী উভয়ই মানুষ । কিন্তু তাদের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যে দৃশ্যমান ভিন্নতা রয়েছে । কামাল ও কবীর দু'জন বন্ধু । দেখা যাবে তাদের চেহারা, গঠন, আচরণ ইত্যাদিতে পৃথক বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় । এভাবেই একটা সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার ভিন্নতা সহজেই নজরে পড়ে। বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও পার্থক্য দৃশ্যমান । প্রতিটা কাজও এক ধরনের নয়। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবস্থাপক, হিসাবরক্ষক-এভাবে প্রত্যেকের কাজের বৈশিষ্ট্যগত ভিন্নতা রয়েছে । তাই ব্যবস্থাপনাকে বুঝতে হলে এর প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানা প্রয়োজন । নিম্নে এরূপ কতিপয় বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো:
১. প্রক্রিয়া বা কাজের সমাহার (Process or group of activities): পরস্পর নির্ভরশীল ধারাবাহিক কাজের সমষ্টিকে প্রক্রিয়া বলে। সেই বিচারে ব্যবস্থাপনাও একটি প্রক্রিয়া। কারণ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে লক্ষ্য অর্জনের জন্য পরিকল্পনা থেকে শুরু করে সংগঠন, কর্মীসংস্থান, নির্দেশনা, প্রেষণা, সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ কার্যাদি পরস্পর সম্পর্ক রেখে ধারাবাহিকভাবে সম্পন্ন হয় । এর একটি কাজে সমস্যা হলে তা অন্য কাজকে সমস্যাগ্রস্ত করে । ফলে লক্ষ্যার্জন ব্যাহত হয় ।
২. সামাজিক প্রক্রিয়া বা কার্যক্রম (Social process or activities): ব্যবস্থাপনা একটি সামাজিক প্রক্রিয়া । এরূপ প্রক্রিয়া বলতে ধারবাহিক কার্যসমষ্টির সাথে সমাজের বা সমাজ সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের সম্পৃক্ততাকে বুঝায় । সেই সাথে এরূপ কাজের সামাজিক উদ্দেশ্যও ক্রিয়াশীল থাকা অপরিহার্য। ব্যবস্থাপনা মানুষকে সংঘবদ্ধ করে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে একটা সমাজ প্রতিষ্ঠা করে। এ ছাড়া ব্যবস্থাপনা তার কাজের মধ্য দিয়ে সমাজ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের প্রতি দায়িত্ব পালন করে থাকে ।
৩. লক্ষ্য অর্জনের উপায় (Means of achieving goals) : কোনো কাজের মূলে যে প্রত্যাশা থাকে তাকে লক্ষ্য বলে । যেকোনো সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মূলে একটা লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ক্রিয়াশীল থাকে । আর এ লক্ষ্য অর্জনের জন্যই ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে মূল লক্ষ্য থাকে মুনাফা অর্জন । তাই ব্যবসায় বা এর ব্যবস্থাপনা মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। এ কারণেই বিভিন্ন লেখক ব্যবস্থাপনাকে লক্ষ্যার্জনের উপায় হিসেবে গণ্য করেছেন ।
৪. কাজ আদায়ের কৌশল (Technique of getting work): প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত উপায়-উপকরণের কার্যকর ব্যবহারের প্রতি ব্যবস্থাপনা গুরুত্বারোপ করে । আর এজন্য ব্যবস্থাপনা সব সময়ই প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত জনশক্তির কাছ থেকে যথাযথ কাজ আদায়ে সচেষ্ট থাকে । এ লক্ষ্যেই পরিকল্পনা, সংগঠন, কর্মীসংস্থান ইত্যাদি কাজ পরিচালিত হয় । এ জন্যই Rue & Byars বলেছেন, "Management is getting things done through others." অর্থাৎ অন্যদেরকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়ার কৌশলই হলো ব্যবস্থাপনা ।
৫. অর্থনৈতিক সম্পদ (Economic resources): উৎপাদনের কাজে লাগে এমন কিছুকেই সম্পদ বলে। ব্যবস্থাপনা একটি মূল্যবান অর্থনৈতিক সম্পদ । সকল উপায়-উপকরণ কাম্য মানে থাকার পরও ব্যবস্থাপনা নামক সম্পদের অপ্রতুলতার কারণে বা অদক্ষতার কারণে লক্ষ্যার্জন সম্ভব হয় না । একই সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত একই ধরনের প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যার্জনে যে ভিন্নতা লক্ষ করা যায় তার মুখ্য কারণ ব্যবস্থাপনার মানগত পার্থক্য । অনুন্নত - দেশসমূহে ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা কার্যত নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের পথে প্রধান অন্তরায় ।
৬. জ্ঞানের পৃথক শাখা (Separate branch of knowledge): জ্ঞানের পৃথক শাখা হিসেবে ব্যবস্থাপনা আজ সর্বত্রই স্বীকৃত । বৃহদায়তন প্রাতিষ্ঠানিক জগতে ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত জ্ঞান ছাড়া দক্ষতার সাথে ব্যবস্থাপনা কার্য পরিচালনা অসম্ভব । বিভিন্ন গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা আজ সংঘবদ্ধ জ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ।
৭. সর্বজনীনতা (Universality): সর্বজনীনতা বলতে সর্বত্রই এর প্রয়োগযোগ্যতা বা উপযোগিতা থাকাকে বুঝায় । ব্যবস্থাপনা এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় যা যে কোনো সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘ব্যবস্থাপনা সর্বজনীন' অর্থাৎ দলবদ্ধ যেকোনো প্রচেষ্টায় ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অনস্বীকার্য । পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল পর্যন্ত যে কোনো সংঘবদ্ধ কর্ম প্রচেষ্টায় ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয় ।
সহজ অর্থে ব্যবস্থাপনা হলো অন্যকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়ার কৌশল । তাই মানুষ যখন সংঘবদ্ধ হয়েছে, পেশা অবলম্বন করেছে, কাজ সম্পাদনে অন্যের সহায়তা গ্রহণ করেছে তখন হতেই ব্যবস্থাপনা বিষয় ও এর চিন্তাধারার ক্রমবিবর্তন শুরু হয়েছে । সমাজ যতই এগিয়েছে ব্যবস্থাপনা শাস্ত্রও ততই গুরুত্বপূর্ণ ও সমৃদ্ধ হয়েছে। নিম্নে ব্যবস্থাপনা তথা ব্যবস্থাপনা চিন্তাধারার ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস তুলে ধরা হলো :
ক) প্রাচীন যুগ (৫০০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টের মৃত্যুর পূর্ব সময় পর্যন্ত) (Ancient period) : প্রাচীন যুগে সমাজ উন্নয়নের ধারা ছিল খুবই ধীরগতিসম্পন্ন। এ সময় বিভিন্ন সভ্যতাকেন্দ্রিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন লক্ষ করা যায় । এই সভ্যতাকে কেন্দ্র করে ব্যবস্থাপনা শাস্ত্র ও এর প্রয়োগে উন্নতি লাভ ঘটে। এর মধ্যে মিসরীয়, ব্যবিলনীয়, হিব্রু, চৈনিক, রোমান, গ্রীক ও ভারতীয় সভ্যতা উল্লেখযোগ্য ।
খ্রিস্টপূর্ব ৫,০০০ অব্দ হতে ৫২৫ অব্দ পর্যন্ত সময়ের কীর্তিসমূহ সর্ব প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার ব্যবস্থাপকীয় ও সাংগঠনিক কৃতিত্বের সাক্ষ্য বহন করে । এ সময়ের প্রাপ্ত কিছু উপদেশনামা হতে ব্যবস্থাপনা শাস্ত্রের উপাদান লক্ষ করা যায় । ব্যবিলনীয় সভ্যতায় ব্যবস্থাপনা চিন্তাধারার উন্নয়নে বিভিন্ন নিয়ম-নীতি প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়নের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়। The Code of Hummurabi এর মধ্যে খুবই উল্লেখযোগ্য। হিব্রু সভ্যতায় হযরত মূসা (আ:)-এর ভূমিকা ব্যবস্থাপনা শাস্ত্রের উন্নয়নে অবদান রাখে । আইন প্রণয়ন, সরকার পরিচালনা ও মানব সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে ব্যবস্থাপক হিসেবে তাঁর অবদান লক্ষণীয় চৈনিক সভ্যতায় ব্যবস্থাপনা চিন্তাধারার উন্নতিতে লাও-জু (Lau-Tzu)-এর অবদান লক্ষ করা যায় । তিনি কার্যপদ্ধতি উন্নয়নের বিভিন্ন উপায় নির্দেশ করেন । তিনি মনে করতেন, ন্যায়পরায়ণতা ও মানবতাবোধ অভ্যাস করার মাধ্যমেই যথাযোগ্য চিন্তাধারা ও কর্ম পরিবেশ গড়ে উঠে । প্রাচীন চীনের প্রশাসনে বিশেষজ্ঞ কর্মী পরামর্শ (Staff advice) এর ব্যবহারের ব্যাপক প্রচলন লক্ষ করা যায় ।
ব্যবস্থাপনা চিন্তাধারার বিকাশে গ্রীক সভ্যতার বিশেষ অবদান রয়েছে । এ সময়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটে । বিশেষায়ণ ও শ্রম বিভাগের ব্যাপক প্রচলনও এ সময়ে লক্ষ করা যায় । দার্শনিক প্লেটো একজন ব্যক্তিকে তার যোগ্যতা অনুযায়ী একটি কাজ অর্পণ করার কথা বলেছেন। এ সভ্যতায় 'সর্বোত্তম পদ্ধতি' উদ্ভাবন ও ব্যবহারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হতো। দার্শনিক সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন, ব্যবস্থাপনা একটি সর্বজনীন বিষয় এবং এটি একটি স্বতন্ত্র ও পৃথক কাজ । তিনি তাঁর লেখনী ও বক্তব্যে সর্বপ্রথম এ বিষয়টি তুলে ধরেন ।
খ) মধ্যযুগ (০০-১৭৫০) (Middle stage) : মধ্যযুগে বিশ্বব্যাপী সামন্তবাদের ব্যাপক প্রচলন লক্ষ করা যায়। এ সময়ে উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ঘটেনি। ফলে ব্যবস্থাপনা শাস্ত্রের উন্নয়নের হারও উল্লেখযোগ্য ছিল না। নয়শত খ্রিস্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কোনো লেখা পাওয়া যায় না । তবে মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) ও খোলাফায়ে রাশেদীন-এর আমলে শাসন ব্যবস্থা ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যে যথেষ্ট অগ্রগতি হয় তা বিভিন্ন বর্ণনা হতে সুস্পষ্টভাবে জানা যায়। মধ্যযুগে যাঁরা ব্যবস্থাপনা শাস্ত্রের উন্নয়নে অবদান রাখেন তাদের সম্পর্কে নিম্নে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো:
১. আল ফারাবি : ৯০০ খ্রিস্টাব্দে আল ফারাবি লিখিতভাবে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা সম্বন্ধে আলোকপাত করেন । তিনি তাঁর লেখনীতে নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজনীয় গুণ এবং পরিত্যাজ্য দোষসমূহ তুলে ধরেন ।
২. ইমাম গাজ্জালি : ১১০০ খ্রিস্টাব্দে ইমাম গাজ্জালি (রঃ) 'নাসিহাত আল মুলক' নামক গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। এখানেও শাসকশ্রেণির প্রয়োজনীয় গুণাবলি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, রাজার আচরণ এমন হওয়া উচিত যাতে তার মৃত্যুর পর রাজা-প্রজা সবাই তাকে হারানোর বেদনা অনুভব করে ।
৩. লুকা প্যাসিওলি : ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে লুকা প্যাসিওলি দু-তরফা হিসাবরক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে আলোকপাত করেন । ইটালিতে এরূপ হিসাব পদ্ধতির ব্যাপক প্রচলন ঘটে। যা হিসাব ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে যথেষ্ট সহায়ক হয় । এজন্য তাঁকে হিসাববিজ্ঞানে 'দু-তরফা দাখিলা পদ্ধতির জনক' বলা হয়ে থাকে । এ সময়ে ইটালিতে অংশীদারি ও যৌথ প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ের প্রচলন লক্ষ করা যায় ।
8. থমাস মুর : মধ্যযুগের শেষের দিকে ব্যবস্থাপনা চিন্তাধারার উন্নয়নে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তাঁদের মধ্যে থমাস মুরের নাম উল্লেখযোগ্য। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘ইউটোপিয়া' নামক গ্রন্থ রচনা করেন । তিনি মনে করতেন, ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের মাধ্যমে অপচয় রোধ করে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি সম্ভব । এতে বিশেষায়ণ এবং মানবশক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয় ।
গ) শিল্প বিপ্লব কাল (১৭৫০-১৮৫০) (Industrial revolution period) : শিল্প বিপ্লবের ফলে উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে ব্যবস্থাপনা শাস্ত্রেও যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে । সর্বপ্রথম বৃটেনে এবং পরে ইউরোপ ও আমেরিকায় ঘটে যাওয়া এ বিপ্লবকালে ব্যবস্থাপনা শাস্ত্রের উন্নয়নে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তাঁদের সম্পর্কে নিম্নে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো :
১. জেম্স স্টিউয়ার্ট : ১৭৬৭ সালে স্যার জেমস স্টিউয়ার্ট রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে তাঁর একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এতে ক্ষমতার উৎস সম্পর্কে তত্ত্ব প্রদান করা হয় এবং শিল্পোৎপাদনে যন্ত্র প্রবর্তনের পক্ষে জোরালো বক্তব্য তুলে ধরা হয় ।
২. এ্যাডাম স্মিথ : ১৭৭২ সালে অর্থনীতি শাস্ত্রের জনক এ্যাডাম স্মিথের ‘ওয়েলথ অব নেশন' নামক গ্রন্থ প্রকাশিত হয় । এতে তিনি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য শ্রমবিভাগের ওপর গুরুত্বারোপ করেন । এ গ্রন্থে ব্যবস্থাপনার বহুবিধ সমস্যা ও ধারণা তুলে ধরা হয় ।
৩. জেম্স ওয়াট ও ম্যাথে বোল্টন : জেম্স ওয়াটকে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবিষ্কারক বলা হয়ে থাকে। এ দুই বিজ্ঞ উদ্ভাবক মিলে স্টীম ইঞ্জিন তৈরির জন্য 'বোল্টন ওয়াট এন্ড সন্স' নামক প্রতিষ্ঠান গঠন করেন । ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে এর সহযোগী সোহো ইঞ্জিনিয়ারিং ফাউন্ড্রিতে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক চিন্তা-ভাবনার প্রয়োগ করা হয় ও যন্ত্রপাতি বিন্যাস এবং দ্রব্যের মানোন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ে। প্রয়োজনীয় গবেষণা ও কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় ।
৪. রবার্ট ওয়েন : তিনি ১৮০০-১৮২৮ সাল পর্যন্ত স্কটল্যান্ডের বিভিন্ন বস্ত্রশিল্পে ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব। পালন করেন । শ্রমিক-কর্মী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তাঁর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার জন্য তাঁকে 'আধুনিক শ্রমিক-কর্মী ব্যবস্থাপনার জনক' নামে অভিহিত করা হয়। তিনি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে, অন্যান্য সম্পদের ওপর বিনিয়োগের তুলনায় মানব শক্তি খাতে বিনিয়োগ কয়েকগুণ লাভজনক ।
৫. চার্লস ব্যাবেজ : তিনি ছিলেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত শাস্ত্রের অধ্যাপক । কম্পিউটার যন্ত্রের আবিষ্কার তাঁর মহান কীর্তি। তিনি তাঁর গ্রন্থে সর্বপ্রথম জোর দিয়ে প্রমাণ করেন যে, একটি সফল ব্যবসায়ে ব্যবস্থাপনা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গণিত শাস্ত্রের প্রয়োগে তিনি অবদান রেখেছেন। তাঁকে কম্পিউটারের জনক বলা হয়ে থাকে ।
ঘ) শিল্প বিপ্লব-পরবর্তী যুগ (১৮৫০-১৯৫০) (Post industrial revolution period) : এ সময়ে যে সকল মনীষী ব্যবস্থাপনা শাস্ত্রের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তার মধ্যে এফ. ডব্লিউ, টেলর, হেনরি ফেয়ল, এইচ. এল. গ্যান্ট, গিলব্রেথ দম্পতি, ওলিভার শেলডন, এলটন মেয়ো (মানর সম্পর্ক মতবাদের জনক), চেস্টার আই. বার্নার্ড (পদ্ধতি বা সিস্টেম মতবাদের জনক) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এ সময়ে ব্যবস্থাপনা নীতি ও তত্ত্বের ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয় এবং বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা একটি ব্যবস্থাপনা মতবাদ হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করে । এ সময়ের দু'জন নামকরা মনীষী সম্পর্কে নিম্নে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো:
১. এফ. ডব্লিউ, টেলর : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরে জন্ম নেয়া এ অসামান্য প্রতিভাধর ব্যক্তি বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার জনক । তিনি তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে (১৮৭০-১৯১৫) সাধারণ শিক্ষানবিস শ্রমিক থেকে বড় কারখানার শীর্ষপদ দখল করেছিলেন। তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিকের ঘাটতি থাকায় উৎপাদন বাড়ানোর জন্য শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির তীব্র প্রয়োজন অনুভূত হয়। শ্রম উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও জনশক্তির পূর্ণ ব্যবহারের জন্য বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তিনি বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার উদ্ভাবন করেন। এতে ব্যবস্থাপনা চিন্তাধারায় ও পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়।
২. হেনরি ফেয়ল : তুরস্কে জন্মগ্রহণকারী ও ফ্রান্সের অধিবাসী এ মহান ব্যক্তি ১৮৬০-১৯১৮ সাল পর্যন্ত একজন খনি প্রকৌশলী হিসেবে বিভিন্ন পদে কর্মরত ছিলেন । তিনি মনে করতেন, ব্যবস্থাপনা তত্ত্বের প্রয়োগ শুধু কারবারি প্রতিষ্ঠানেই নয় সকল ধরনের সংগঠনেই প্রয়োগযোগ্য এবং ব্যবস্থাপনা শিক্ষার প্রসার অত্যন্ত জরুরি । তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম ব্যবস্থাপনা রীতি-পদ্ধতির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেন। তিনি কার্য বিভাগীয়করণেরও বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন এবং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অনুসরণীয় ১৪টি মূলনীতির নির্দেশ করেন। যা অদ্যাবধি সর্বজনগ্রাহ্য মূলনীতি হিসেবে অনুসৃত হয়। তাঁর অসামান্য অবদানের জন্যই তাঁকে ব্যবস্থাপনা তত্ত্বীয় ধারার অগ্রদূত ও আধুনিক ব্যবস্থাপনার জনক' বলা হয়ে থাকে ।
ঙ) আধুনিক যুগ (Modern stage) : শিল্প বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে ব্যবস্থাপকীয় তত্ত্ব ও এর প্রয়োগ পদ্ধতি নিয়ে যে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে পরবর্তী সময়েও তা অব্যাহত রয়েছে । এ সময়ে বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানী ও আচরণ বিজ্ঞানীদের চিন্তাধারার দ্বারা ব্যবস্থাপনা তত্ত্ব প্রভূত উন্নতি লাভ করেছে । এর মধ্যে ডগলাস ম্যাকগ্রেগর, হার্জবার্গ, পিটার এফ. ড্রাকার, উইলিয়াম ও'চি প্রমুখ মনীষীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও ই. এফ. এল. ব্রেক, নিউম্যান, কুঞ্জ ও ডোনাল, আরনেস্ট ডেল, ট্রিওয়াথা ও নিউপোর্ট প্রমুখ মনীষীদের লেখনী আধুনিক ব্যবস্থাপনা চিন্তাধারাকে একটি বিশেষ মর্যাদার আসনে সমাসীন করতে সহায়তা করেছে । Z তত্ত্বের প্রবর্তক উইলিয়াম ও'চি-এর নাম আধুনিক ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত স্মরণীয় ।
যে কোনো সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত শক্তিশালী উপাদান। এটি এমন এক শক্তি যা প্রতিষ্ঠানের সকল উপায়-উপকরণকে কার্যকরভাবে সংগঠিত ও লক্ষ্যপানে পরিচালিত করে। ব্যবস্থাপনাকার্য দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে পরিচালিত হলে তা যেমনি প্রতিষ্ঠানকে সফলতা দান করে তেমনি ব্যবস্থাপনা কার্যে অদক্ষতা প্রদর্শিত হলে উপায়-উপকরণ যত উন্নত হোক না কেন তা কোনো কার্যকর ফল দিতে পারে না । পাশাপাশি দু'টি হাসপাতাল । একই পরিমাণ মূলধন ও ভৌত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে প্রতিষ্ঠান দু'টি যাত্রা শুরু করেছিল। একটা এগিয়ে যাচ্ছে ও অন্যটা পিছিয়ে পড়ছে। পার্থক্যের কারণ খুঁজলে দেখা যাবে একটার ব্যবস্থাপনা অন্যটির চেয়ে উত্তম । একই এলাকায় একাধিক কলেজ রয়েছে । দেখা যাবে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা কোনো কলেজে ভিড় জমাচ্ছে । কারণ ঐ কলেজটির ব্যবস্থাপনা অন্যটির চেয়ে ভালো । এভাবেই প্রতিটা পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রসহ সর্বত্রই সঠিক পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । নিম্নে ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব আলোচনা করা হলো:
১. উপকরণাদির সুষ্ঠু ব্যবহার (Proper utilization of resources) : উপকরণ বলতে কার্যসম্পাদনের জন্য ব্যবহার্য বস্তকে বুঝায় । তাই উৎপাদনের কাজে লাগে এমন প্রয়োজনীয় বস্তুকে উৎপাদনের উপকরণ বলে । ভূমি, শ্রম, মূলধন ইত্যাদি উপকরণ কোথাও থাকাই উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট নয় । এগুলোর যথাযথ ব্যবহারের জন্য যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তাই ব্যবস্থাপনা । Terry ও Franklin বলেছেন, “ব্যবস্থাপনা হলো সেই ধরনের কাজ যা অসংগঠিত মানুষ ও বস্তুগত সম্পদকে ব্যবহারযোগ্য ও ফলদায়ক পরিণতির দিকে নিয়ে যায়।” একজন ভালো কৃষক ভূমি, শ্রম, মূলধন, ট্রাক্টর, সেচযন্ত্র, সার, বীজ ইত্যাদির কার্যকর ব্যবহার করে অধিক ফসল ফলিয়ে উন্নয়ন নিশ্চিত করে । একজন শিল্পমালিক তার জনশক্তি, যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, অর্থ, বাজার, পদ্ধতি ইত্যাদির সঠিক ব্যবহার করে শিল্পকে এগিয়ে নেয়। একজন সফল রাষ্ট্রপ্রধান যোগ্য নেতৃত্বদানের মাধ্যমে সবার মধ্যে আশাবাদ সৃষ্টি এবং প্রশাসনের সর্বস্তরে গতিশীলতা এনে দেশের সকল সম্ভাবনাকে কাজে লাগায় । তাই উপকরণের কার্যকর ব্যবহারে যোগ্য ব্যবস্থাপনার বা ব্যবস্থাপকের বিকল্প নেই।
২. দক্ষতা বৃদ্ধি (Increase of efficiency) : দক্ষতা হলো কম খরচ (Input) এ বেশি কাজ বা ফল (Output) লাভের সামর্থ্য। সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করতে পারাও দক্ষতা হিসেবে গণ্য। ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের কাজের দক্ষতা বৃদ্ধি করে। কারণ উত্তম ব্যবস্থাপনার অধীনে এর প্রতিটা জনশক্তির দক্ষতা বাড়ে। ফলে বস্তুগত উপকরণ; যেমন- যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, মূলধন ইত্যাদির দক্ষতাও বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি একই ধরনের ও মানের দু'টি প্রতিষ্ঠান। একটা প্রতিষ্ঠানে কর্মীরা একই সময়ে যে পরিমাণ উৎপাদন করে অন্য প্রতিষ্ঠানে তার চেয়ে কম উৎপাদন হয় । এতে প্রথম প্রতিষ্ঠানটি প্রতিযোগিতায় ভালো করবে । সেখানে অপচয় হ্রাস পাবে এবং মুনাফার পরিমাণ বাড়বে । অন্যদিকে পরের প্রতিষ্ঠানটিতে পূর্ববৎ অবস্থা চলতে থাকলে একদিন প্রতিযোগিতার বাজারে তা পিছিয়ে পড়বে । তাই একটা প্রতিষ্ঠানের সার্বিক দক্ষতা ব্যবস্থাপনার ভাল-মন্দের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল ।
৩. শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা (Establishment of discipline) : শৃঙ্খলা বলতে রীতি, নিয়ম, নীতি, সুব্যবস্থা ইত্যাদিকে বুঝায় । একটা প্রতিষ্ঠানে যদি এগুলো না থাকে তবে ঐ প্রতিষ্ঠান কখনই ভালো চলতে পারে না। একটা পরিবারের কথাই ধরা যাক, যেখানে যদি কোনো নিয়ম-রীতি না থাকে, যে যার মতো চলে, কোনো মান্যতা ও ভব্যতা না থাকে তবে শান্তি ও উন্নতি সেখানে আশা করা যায় না । একটা প্রতিষ্ঠান, সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই এ বিষয়টি প্রযোজ্য । একটা প্রতিষ্ঠানে এই শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব থাকে মূলত পরিচালক বা ব্যবস্থাপকগণের ওপর । তারা যদি তাদের কাজের মধ্য দিয়ে সর্বক্ষেত্রে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হন তবে ঐ প্রতিষ্ঠান ভালো চলতে পারে না । আমাদের দেশে সর্বক্ষেত্রে যে বিশৃঙ্খলা লক্ষণীয় এর পিছনে মূল কারণ হলো ব্যবস্থাপনা বা প্রশাসনের অদক্ষতা ।
৪. উত্তম সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা (Establishment of cordial relationship) : একটা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ; যেমন- মালিক, ব্যবস্থাপক, শ্রমিক-কর্মী, ক্রেতা ও ভোক্তা, সরবরাহকারী ইত্যাদি সবার সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকা বর্তমানকালে খুবই গুরুত্বপূর্ণ । একটা প্রতিষ্ঠানের দক্ষ ব্যবস্থাপনাই শুধুমাত্র তা নিশ্চিত করতে পারে । একটা পরিবারে বাবা-মার মধ্যে যদি উত্তম সম্পর্ক না থাকে তবে ঐ পরিবারে অশান্তির শেষ থাকে না । সন্তানদের মধ্যেও অস্থিরতা ও অস্বাভাবিকতা জন্ম নেয় । একটা প্রতিষ্ঠানেও এ কথা সর্বোতভাবে প্রযোজ্য । মালিক বা ব্যবস্থাপকদের মধ্যে যদি পারস্পরিক সম্পর্কের অভাব থাকে, গ্রুপিং-লবিং যদি নিত্যকার বিষয় হয় তবে নিচের স্তরে কর্মরত শ্রমিক-কর্মীরা তার দ্বারা দ্রুত প্রভাবিত হয়ে থাকে । এতে প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক, স্বচ্ছন্দ ও কর্মমুখী পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় । একটা প্রতিষ্ঠানের দক্ষ ব্যবস্থাপনাই শুধু সর্বস্তরে উত্তম সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে সে অবস্থা থেকে প্রতিষ্ঠানকে সুরক্ষাদান ও সামনে এগিয়ে নিতে পারে ।
৫. কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি (Creation of employment opportunity) : কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি বলতে মানুষকে কাজে লাগানোর মতো নতুন নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টিকে বুঝায় । উত্তম ব্যবস্থাপনা শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নই নিশ্চিত করে না ব্যবসায় সম্প্রসারণ ও নতুন নতুন ব্যবসায় গঠনের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে স্কয়ার গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ, প্রাণ গ্রুপসহ যে সকল প্রতিষ্ঠান দেশকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে- তা তাদের ব্যবস্থাপনার দক্ষতার কারণেই সম্ভব হয়েছে । বাংলাদেশের গার্মেন্টস ব্যবসায়ীগণের অনেকেই তাদের ব্যবস্থাপনার দক্ষতার কারণে নানান সীমাবদ্ধতার মধ্যেও নতুন নতুন কারখানা গড়ে হাজারো শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে সমর্থ হয়েছেন । এতে দেশে যেমনি বেকার সমস্যার লাঘব হচ্ছে সেই সাথে মানুষের আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশ ও সমাজ উপকৃত হচ্ছে ।
ব্যবস্থাপনার কার্য সম্পাদনে প্রয়োজনে লাগে এমন বস্তু বা সম্পদকেই ব্যবস্থাপনার উপকরণ বলে । ব্যবস্থাপনা হলো উপকরণাদির কার্যকর ব্যবহার করে লক্ষ্যে পৌঁছানোর কৌশল বা প্রক্রিয়া । যার সাথে পরিকল্পনা সংগঠনসহ অন্যান্য কাজ সম্পৃক্ত । এরূপ উপকরণের মধ্যে মানবীয় ও বস্তুগত বিভিন্ন উপকরণ অন্তর্ভুক্ত। Terry ও Franklin তাকে 6'M' নামে সংক্ষেপে প্রকাশ করেছেন । নিম্নে এরূপ উপকরণসমূহ আলোচনা করা হলো:
১. মানুষ (Men): মানুষ হলো সৃষ্টির সেরা জীব। স্রষ্টা সৃষ্টির সকল বস্তুগত উপকরণকে মানুষের জন্য কল্যাণকর করে সৃষ্টি করেছেন। যা মানুষ উদ্দেশ্য অর্জনে ব্যবহার করে। প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত এই মানব সম্পদকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করে বা তাদেরকে সঠিকভাবে পরিচালনা করে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য ব্যবস্থাপক চেষ্টা চালায় । মানব সম্পদের কার্যকর ব্যবহার সম্ভব হলে আপনা-আপনি প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত অন্যান্য বস্তুগত উপকরণের কার্যকর ব্যবহার সম্ভব হয় ।
২. মালামাল (Materials): মালামাল বলতে উৎপাদন বা বিক্রয় কার্যে অথবা প্রতিষ্ঠানের কাজে ব্যবহার্য কাঁচামাল বা প্রস্তুত পণ্যকে বুঝায় । যেকোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান পণ্য উৎপাদন বা তা সংগ্রহ করে বাজারজাত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকে । সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলো সেবা বিক্রয় করলেও প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় নানান ধরনের মালামাল বা সম্পদ সংগ্রহ ও ব্যবহার করে । এরূপ মালামাল মানসম্মত না হলে মানবীয় প্রচেষ্টা ফলপ্রদ করা সম্ভব হয় না।
৩. যন্ত্রপাতি (Machines): প্রয়োজনীয় দ্রব্য বা সেবা উৎপাদনের হাতিয়ারকে যন্ত্রপাতি বলে । ব্যবস্থাপনার মৌল উপকরণের মধ্যে যন্ত্রপাতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ । উৎপাদনধর্মী প্রতিষ্ঠানসমূহে উপযুক্ত মানের যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা না গেলে তা থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে উন্নতমানের পণ্য বা সেবা উৎপাদন সম্ভব হয় না । এ জন্য বর্তমানকালে প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন উন্নতমানের যন্ত্রপাতি সংগ্রহের চেষ্টা চালায় ।
৪. অর্থ (Money): অর্থ বলতে ধন, সম্পত্তি বা বিত্তকে বুঝায় । অর্থনীতির ভাষায় বিনিময়ের মাধ্যমকে অর্থ বলে । সাধারণভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইস্যুকৃত বিহিত মুদ্রাকে অর্থ বলা হয়। যেকোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ব্যবস্থাপনার অন্যতম উপাদান হলো এই অর্থ । অর্থ বা পুঁজি ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানই কার্যত গঠন ও পরিচালনা করা যায় না । প্রয়োজনীয় অর্থ যথাসময়ে সংগ্রহ, অর্থের কার্যকর ব্যবহার, এর যথাযথ পরিচালনা- এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয় ।
৫. বাজার (Market): বাজার হলো নির্দিষ্ট সময়ে কোনো নির্দিষ্ট স্থান বা এলাকায় কোনো পণ্য বা সেবার বিদ্যমান ও সম্ভাব্য চাহিদার সমষ্টি । যেকোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় বর্তমানকালে এই বাজার বা চাহিদা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে গণ্য। ব্যবসায় গঠনে একজন দক্ষ উদ্যোক্তা সহজেই পুঁজি এবং স্বয়ংক্রিয় ও উন্নত যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করতে পারে। কিন্তু প্রতিযোগিতাপূর্ণ ব্যবসায় জগতে বাজার সৃষ্টি অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। বাজার না থাকলে বা বাজার সৃষ্টি করা না গেলে কোনো ব্যবসায়ই সফলতা লাভ করতে পারে না । সৃষ্ট বাজার ধরে রাখাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ।
৬. পদ্ধতি (Method): কার্য সম্পাদনের জন্য গৃহীত কার্যক্রমকে পদ্ধতি বলে । কার্যক্ষেত্রে ব্যবহৃত পদ্ধতিও ব্যবস্থাপনার অন্যতম উপকরণ। যেকোনো প্রতিষ্ঠানেই দীর্ঘদিনের কর্মপ্রচেষ্টার মধ্যদিয়ে প্রতিটা কাজের সুবিধাজনক উপায় বা পদ্ধতির উন্নয়ন ঘটে । কার্যকর পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়, সময়ের সাশ্রয় ঘটে এবং দ্রুত কার্য সম্পাদন সম্ভব হয় । একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভালো চলার পিছনে উত্তম পরীক্ষা ও ক্লাস অনুষ্ঠান পদ্ধতির অবদান আমরা সহজেই লক্ষ করতে পারি ।
প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত উপকরণাদির কার্যকর ব্যবহারের প্রয়াস বা প্রক্রিয়াকেই ব্যবস্থাপনা বলে । প্রক্রিয়া বলতে পরস্পর নির্ভরশীল ধারাবাহিক কাজের সমষ্টিকে বুঝায় । যার প্রতিটা কাজ প্রকৃত অর্থেই সম্পূর্ণ ফল দিতে পারে না । একইভাবে কাজগুলো ধারবাহিকভাবে সম্পাদিত না হলে তাথেকেও কার্যকর ফললাভ অসম্ভব । যদি আমরা চিনি উৎপাদন প্রক্রিয়ার কথা ধরি- তা হলে দেখা যাবে এর কাজগুলো ধারাবাহিক ও পরস্পর নির্ভরশীল নিম্নে সংক্ষেপে তা দেখানো হলো :
উল্লেখ্য এই প্রক্রিয়ার প্রতিটা ধাপ সুচারুভাবে সম্পাদিত হলেই সম্পূর্ণ চিনি পাওয়া সম্ভব । এর কোনো কাজে বিচ্যুতি ঘটলে প্রকৃত ফল অর্থাৎ সম্পূর্ণ চিনি পাওয়া সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে প্রতিটা কাজ একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল এবং তা ধারাবাহিকতা মেনে সম্পন্ন হয়। ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়াতেও এমন কতকগুলো কাজ আমরা দেখতে পাই যা পরস্পর নির্ভরশীল ও ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সম্পন্ন হয়ে থাকে । প্রক্রিয়ার কাজগুলো নিমে রেখাচিত্রের সাহায্যে দেখানো হলো :
ব্যবস্থাপনা বিশারদগণ ব্যবস্থাপনার এ কাজ বা কর্ম প্রক্রিয়াকে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন । তার কতিপয় ছকের সাহায্যে নিম্নে তুলে ধরা হলো :
বিশেষজ্ঞের নাম | ব্যবস্থাপনা কার্যাবলি |
১. হেনরি ফেয়ল | পূর্বানুমান ও পরিকল্পনা, সংগঠন, আদেশদান, সমন্বয়সাধন ও নিয়ন্ত্রণ । |
২. অইরিক ও কুঞ্জ | পরিকল্পনা, সংগঠন, কর্মীসংস্থান, নেতৃত্বদান ও নিয়ন্ত্রণ । |
৩. এল. গুলিক | পরিকল্পনা, সংগঠন, কর্মীসংস্থান, নির্দেশনা, সমন্বয়সাধন, রিপোর্ট প্রদান ও বাজেট প্রণয়ন। (সংক্ষেপে-POSDCORB : P= Planning; O = Organizing; S = Staffing; D = Directing; Co = Co-ordinating; R = Reporting; B = Budgeting.) |
৪. আরনেস্ট ডেল | পরিকল্পনা, সংগঠন, কর্মীসংস্থান, নির্দেশনা, নিয়ন্ত্রণ, উদ্ভাবন ও উপস্থাপন । |
৫. হিস ও গুলেট | সৃষ্টিকরণ, পরিকল্পনা, সংগঠন, প্রেষণা, যোগাযোগ ও নিয়ন্ত্রণ । |
ছকে উল্লেখ ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ার প্রধান কার্যাবলি নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. পরিকল্পনা (Planning): ভবিষ্যতে কী করা হবে তা আগাম ঠিক করাকেই পরিকল্পনা বলে । ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ার প্রথম কাজ হলো পরিকল্পনা । এটি ব্যবস্থাপনার অন্যান্য কাজের ভিত্তিস্বরূপ । পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যবস্থাপনার অন্যান্য কাজ ধারাবাহিকতা মেনে সম্পন্ন হয় । তাই পরিকল্পনা গ্রহণে ব্যবস্থাপকগণকে অত্যন্ত সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন পড়ে । শুধু কী করা হবে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণকেই পরিকল্পনা হিসেবে না দেখে কখন ও কোথায় করা হবে, কত সময়ের মধ্যে করতে হবে, কে বা কারা তা সম্পাদন করবে ইত্যাদি প্রয়োজনীয় সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার প্রয়োজন পড়ে। তবেই তা একটা আদর্শ পরিকল্পনা বিবেচিত হয় । ধরা যাক, কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটা বনভোজন অনুষ্ঠিত হবে । অধ্যক্ষ স্যার একটা কমিটি করে দিলেন । কমিটিকে এক্ষেত্রে বনভোজনের তারিখ, স্থান, যাওয়ার উপায়, খাবারের মেন্যু, চাঁদার পরিমাণ ইত্যাদি বিষয়ে অগ্রিম . সিদ্ধান্ত নিতে হবে । এর সবটাই পরিকল্পনা হিসেবে গণ্য ।
২. সংগঠন (Organizing) : গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য উপকরণাদিকে সংগঠিত ও কাজে লাগানোর উপযোগী করাকেই সংগঠন বলে। ইট, বালি, সিমেন্ট, রড ইত্যাদি যখন আলাদা থাকে তখন তা কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না । এই উপকরণগুলোকে যখন একত্রিত করে নির্মাণের কাজে লাগানো হয় তখন তা
থেকে বিল্ডিং, সেতু ইত্যাদি নির্মিত হয় । মানুষগুলো যখন আলাদা-আলাদা থাকে তখন তাদের দ্বারাও কিছু সৃষ্টি হয় না । কিন্তু যখন কাজ ভাগ করে তা মানুষগুলোকে বুঝিয়ে দেয়া হয়, দায়িত্ব ও ক্ষমতা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়, একের সাথে অন্যের সম্পর্ক বলে দেয়া হয় তখন এই মানুষগুলো একটা সংগঠনে রূপায়িত ও কর্মক্ষম হয়ে ওঠে । তাই উদ্দেশ্য অনুযায়ী কাজকে বিভাজন, প্রতিটা কাজের জন্য দায়িত্ব ও ক্ষমতা নির্দিষ্টকরণ এবং সে অনুযায়ী
উপায়-উপকরণকে সংহত করে তাদের মধ্যে সম্পর্ক নির্দিষ্ট করার কাজকে সংগঠন বলা হয়ে থাকে ।
৩. কর্মীসংস্থান (Staffing) : প্রতিষ্ঠানের জন্য যোগ্য ও দক্ষ কর্মী বাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে উপযুক্ত কর্মী সংগ্রহ, নির্বাচন, নিয়োগ ও উন্নয়নের কাজকেই কর্মীসংস্থান বলে । সংগঠন প্রক্রিয়ায় কাজ এবং প্রতিটা কাজের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব নির্ধারণের পর ঐ কাজ সম্পাদনের জন্য যোগ্য জনবল সংস্থানের প্রয়োজন পড়ে । এই জনবলের যোগ্যতা, আগ্রহ ও আন্তরিকতার ওপর প্রতিষ্ঠানের সাফল্য নির্ভর করে। তাই কর্মী নিয়োগে ভুল করলে প্রতিষ্ঠানকে দীর্ঘমেয়াদে তার কুফল ভোগ করতে হয়। ধরা যাক, কলেজের গেটের জন্য যোগ্য নিরাপত্তা রক্ষীর প্রয়োজন । এক্ষেত্রে এ ধরনের কর্মীর উচ্চতা, বয়স, বুকের মাপ, সুস্থতা, পরিশ্রম করার ক্ষমতা, সাহস ইত্যাদি বিষয় দেখা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে যদি দুর্বল ও রোগগ্রস্ত লোক নিয়োগ দেয়া হয় তবে তার নিকট থেকে উপযুক্ত সার্ভিস কখনই প্রত্যাশা করা উচিত নয় । তাই কোথায়, কোন মানের, কি সংখ্যক লোকের প্রয়োজন সে অনুযায়ী যোগ্য কর্মী নিয়োগ করতে হয় ।
৪. নেতৃত্ব / নেতৃত্বদান (Leading) : কোনো দল বা গোষ্ঠীর আচরণ ও কাজকে লক্ষ্যপানে এগিয়ে নেয়ার কৌশলকেই নেতৃত্ব বলে । যিনি বা যারা এরূপ প্রয়াস চালান তাকে বা তাদেরকে নেতা বলা হয়ে থাকে । নেতৃত্ব দানের বিষয়টি ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ । প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্যার্জনের জন্য আদেশ দেয়া, পরিচালনা করা, প্রভাবিত করা, উৎসাহিত করা, স্বেচ্ছাপ্রণোদিত করা, দলগত প্রচেষ্টা জোরদার করা ইত্যাদি বিষয় এর সাথে সম্পৃক্ত । তাই ব্যবস্থাপনায় নির্দেশনা, প্রেষণা ও সমন্বয় কাজ নেতৃত্বের অন্তর্ভুক্ত বলেই গণ্য হয় । সেজন্য আমেরিকান বইগুলোতে ব্যবস্থাপনার কাজ উল্লেখ করতে যেয়ে পরিকল্পনা, সংগঠন, নেতৃত্বদান ও নিয়ন্ত্রণ- এভাবে কাজের পরম্পরা উল্লেখ করা হয়ে থাকে । অবশ্য এখন অনেকেই পরিকল্পনা সংগঠন, কর্মীসংস্থান, নেতৃত্বদান ও নিয়ন্ত্রণ— এ পাঁচটি কাজকে ব্যবস্থাপনার কাজ হিসেবে গণ্য করেন। নিম্নে নেতৃত্বের আওতাধীন ব্যবস্থাপনার কাজসমূহ উল্লেখ করা হলো :
ক. নির্দেশনা (Directing) : অধস্তন জনশক্তিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দান, তত্ত্বাবধান, উপদেশ ও পরামর্শ প্রদান এবং অনুসরণ (Follow-up) কার্যকে নির্দেশনা বলে। যোগ্য জনবল কোথাও থাকলেই তারা কাজ করবে এমন প্রত্যাশা করা যায় না । কী কাজ করবে এ বিষয়ে সময়ে সময়ে আদেশ-নির্দেশ প্রদান করতে হয় । তারা সঠিকভাবে কাজ করছে কি না বা করতে পারছে কি না তা তত্ত্বাবধানের প্রয়োজন পড়ে। ক্ষেত্রবিশেষে উপদেশ ও পরামর্শ প্রদান এবং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাদেরকে অনুসরণ (Follow) করতে হয় । একটা কারখানায় সপ্তাহে ১০০ একক পণ্য উৎপাদনের পরিকল্পনা নেয়া হলো । এখন যদি এক সপ্তাহ পর খোঁজ-খবর নেয়া হয় কাজ কী হয়েছে? তবে দেখা যাবে কাজ পুরোটা হয়নি। অধস্তনরা নানান সমস্যার কথা বলবে, কারণ দর্শাবে। এক্ষেত্রে যদি উর্ধ্বতন প্রতিদিনের কাজের খোজ-খবর নিতেন, সমস্যা দেখা দিলে সেভাবে পরামর্শ বা নির্দেশনা দিতেন, পুরো সপ্তাহের কাজ সেভাবে দেখা হতো তবে কার্যফল আরও আশাব্যঞ্জক হতে পারতো ।
খ. প্রেষণা (Motivation): অধস্তন কর্মীদের কাজের প্রতি অনুপ্রাণিত ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত করার কাজকে প্রেষণা বলে । কর্মীদের কোনো কাজ করতে বললেই তারা সবসময় আন্তরিকতা নিয়ে সম্পাদন করবে এটা আশা করা যায় না। যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য বস্তুগত উপকরণের সাথে জনশক্তির এখানেই বড় পার্থক্য বিরাজমান । জনশক্তি যদি কাজে স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত না হয় তবে তাদের যতই আদেশ-নির্দেশ প্রদান করা হোক, তত্ত্বাবধান করা হোক তা কখনই কাঙ্ক্ষিত ফল দিতে পারে না। ভীতি প্রদর্শন বা কাজে চাপ সৃষ্টি করলে স্বল্প সময়ের জন্য কখনও কিছুটা ভাল ফল লক্ষ করা গেলেও বাস্তবে তা কার্যকর নয়। তাই ব্যবস্থাপনার পক্ষ থেকে কর্মীদের উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করে কাজ আদায় এবং প্রতিষ্ঠানে ধরে রাখার কাজ বর্তমানকালে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । এজন্য আর্থিক ও অনার্থিক বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দেয়ার প্রয়োজন পড়ে ।
গ. সমন্বয়সাধন (Coordination) : বিভিন্ন ব্যক্তি ও বিভাগের কাজকে একসূত্রে গ্রথিত ও সংযুক্ত করার কাজকে সমন্বয় বলে । একটা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ব্যক্তি ও বিভাগ কাজ করে । প্রতিটা ব্যক্তি ও বিভাগ যদি নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করে, অন্যের সাথে নিজের কাজের সমন্বয় বা সংযুক্তির বিষয়টি না ভাবে তবে দেখা যাবে এক পর্যায়ে সামগ্রিক কাজে প্রচণ্ড বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে। তাই সম্মিলিত যে কোন কাজে সকল ব্যক্তি ও বিভাগকে প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য অর্জন বা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অন্যের সাথে তাল মিলিয়ে চলার প্রয়োজন পড়ে। এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব উর্ধ্বতন নেতৃত্বের । উৎপাদন বিভাগ যদি ইচ্ছামতো উৎপাদন করে এবং বিক্রয় বিভাগ তার সাথে তাল মিলিয়ে বিক্রয় করতে ব্যর্থ হয় তবে এক পর্যায়ে মজুত পণ্য অবিক্রিত থাকবে এবং তা সকল ক্ষেত্রে মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি করবে ।
৫. নিয়ন্ত্রণ (Controlling): পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের কার্যাদি সম্পন্ন হয়েছে কি না তা পরিমাপ, বিচ্যুতি ঘটলে তার কারণ নির্ণয় ও বিশ্লেষণ এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনী ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ বলে। প্রতিষ্ঠানের যে কোনো কাজ শুরুর পূর্বে পরিকল্পনা প্রণীত হয় । তার আলোকে উপায়-উপকরণাদিকে সংহত করা হয়ে থাকে । এরপর অধস্তনদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও প্রেষণা দেয়া হয়। কার্য চলাকালে বিভিন্ন বিভাগের কাজে সমন্বয়সাধন করা হয়। এরপর সময় শেষে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ কতটা সম্পন্ন হয়েছে তা মূল্যায়নের প্রয়োজন পড়ে । এতে ব্যবস্থাপনা কার্য কতটা দক্ষতার সাথে পরিচালিত হয়েছে তার প্রমাণ মেলে । ধরা যাক, একটা প্রতিষ্ঠান তিন মাসে ১০,০০০ একক পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয়ের পরিকল্পনা নিয়েছিল। সে অনুযায়ী ব্যবস্থাপনার অন্যান্য কাজ পরিচালিত হয় । তিন মাস পর অবশ্যই দেখতে হবে যে, কতটা ফল অর্জিত হয়েছে এবং বিচ্যুতি হলে কেন তা ঘটেছে। যাতে পরবর্তী পরিকল্পনার মাধ্যমে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। এতে ব্যবস্থাপনার জবাবদিহিতা ও কার্যদক্ষতার মান বৃদ্ধি পায় । উল্লেখ্য, এ সময়কাল দিন, সপ্তাহ, মাস বা বছরও হতে পারে ।
সাধারণ অর্থে, ব্যবস্থাপনার কাজ হলো অন্যের মাধ্যমে কাজ সম্পাদন করা । প্রাচীনকালে মানুষ যখন নিজের অভাব নিজেই পূরণ করত তখন ব্যবস্থাপনার বিষয় চিন্তায় আসেনি। যখন মানুষ সমাজবদ্ধ হলো, উৎপাদন বাড়তে লাগলো কার্যত সভ্যতা যতই এগুলো মানুষের কর্মপ্রচেষ্টাও তত সম্প্রসারিত হলো এবং সেই সাথে তাল মিলিয়ে ব্যবস্থাপনাও গুরুত্ব লাভ করলো । এই গুরুত্বের সাথে ব্যবস্থাপনার আওতা বা পরিধি বেড়ে গেলো । বর্তমানে ব্যবস্থাপনা শুধুমাত্র শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্যেই কেন্দ্রীভূত নয়; সরকারি-বেসরকারি, বাণিজ্যিক- অবাণিজ্যিক সকল প্রতিষ্ঠানেই এটি একটি প্রধান কার্য হিসেবেই বিবেচিত । বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে ব্যবস্থাপনার আওতা নিম্নে তুলে ধরা হলো :
১. প্রতিষ্ঠানভেদে ব্যবস্থাপনার আওতা (Scope of management from institutional point of view) : গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে বলেছিলেন, “ব্যবস্থাপনা সর্বজনীন” (Management is universal)। যেখানেই একের অধিক মানুষ একত্রে বাস করে সেখানেই কোনো না কোনোভাবে একটা ব্যবস্থাপনার অস্তিত্ব লাভ ঘটে । তাই পরিবারে যেমনি একটি ব্যবস্থাপনার অস্তিত্ব বিরাজমান তেমন সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্রই ব্যবস্থাপনা ক্রিয়াশীল । পরিবারে পিতা বা মাতা যেমনি একজন ব্যবস্থাপক তেমনি রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীও একজন ব্যবস্থাপক । তাই যেখানে যে উদ্দেশ্যেই প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে বা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয় সেখানেই ব্যবস্থাপনার অস্তিত্ব লক্ষণীয় । নিম্নে প্রতিষ্ঠানভেদে ব্যবস্থাপনার আওতা তুলে ধরা হলো :
ক) সামাজিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান : এর আওতাভুক্ত হলো পরিবার, সমাজ, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, ক্লাব, লাইব্রেরি, সামাজিক সংস্থা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, এনজিও প্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার ইত্যাদির ব্যবস্থাপনা ।
খ) রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান : এর অধীন হলো ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা ও জেলা পরিষদ, সিটি কর্পোরেশন, পুলিশ প্রশাসন, শিক্ষা প্রশাসন, ডাক, টেলিযোগাযোগ, সড়ক যোগাযোগ, রেল, বিমান, বাংলাদেশ ব্যাংক, ওয়াসা, রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক সংস্থা, মন্ত্রণালয় ইত্যাদির ব্যবস্থাপনা ।
গ) ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান : বিভিন্ন ধরনের বড়, মাঝারি, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, খুচরা, পাইকারি, আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বিমা, পরিবহন, গুদামজাতকরণ, বিজ্ঞাপনি সংস্থা, হোটেল, হাসপাতাল, ক্লিনিক ইত্যাদি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা এর অধীন । ঘ) আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান : জাতিসংঘ ও এর অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, আন্তর্জাতিক আদালত, শ্রম সংস্থা, এডিবি, আইডিবি, সার্ক, আসিয়ান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইত্যাদির ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা এর মধ্যে পড়ে ।
২. কাজের দৃষ্টিকোণ হতে ব্যবস্থাপনার আওতা (Scope of management from functional point of view) : একজন ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের কাজ সম্পাদন করেন। স্বনামধন্য ব্যবস্থাপনাবিদ পিটার এফ. ড্রাকারের মতে, ব্যবস্থাপনা নিম্নোক্ত তিন ধরনের কাজ সম্পাদন করে যা ব্যবস্থাপনার আওতাধীন :
ক) প্রতিষ্ঠান পরিচালনা : প্রতিষ্ঠান পরিচালনা বলতে একটি প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত উপায়-উপাদানের সুষ্ঠু পরিচালনা বা নেতৃত্ব প্রদানকে বুঝায় । তাই ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে অধিক মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গৃহীত সকল কার্যই ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত ।
খ) ব্যবস্থাপকদের ব্যবস্থাপনা : প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্তরের নির্বাহী বা ব্যবস্থাপকগণ কর্মরত থাকেন। তাই প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ স্তর হতে একেবারে নিচের স্তরে নিয়োজিত ফোরম্যান বা সুপারভাইজার পর্যায়ের সব লোকেরাই ব্যবস্থাপনার আওতাধীন । যাদের ব্যবস্থাপনাও এর অধিনে গড়ে ।
গ) শ্রমিক-কর্মী পরিচালনা : শ্রমিক-কর্মীরাই হলো প্রতিষ্ঠানে প্রত্যক্ষভাবে কার্য সম্পাদনে নিয়োজিত পক্ষ । তাই তাদের নিকট হতে যথাযথ কাজ আদায়ের নিমিত্তে পরিকল্পনা গ্রহণ, সংগঠন, কর্মী নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, পদোন্নতি, কর্মী পরিচালনা, নির্দেশনা, প্রেষণা, সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণের মতো সর্ববিধ কার্যাবলি গ্রহণ করতে হয় । এগুলো ব্যবস্থাপনা কার্যের অধীন।
৩. কৌশল প্রয়োগের ভিত্তিতে আওতা (Scope of management from strategic point of view) : একজন ব্যবস্থাপককে লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য বিভিন্ন ধরনের কৌশল অবলম্বন করতে হয় । প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে সফলতার সাথে টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন ধরনের রণকৌশল গ্রহণ করার প্রয়োজন পড়ে। এরূপ কৌশল গ্রহণের জন্য তথ্য সংগ্রহ, তথ্য বিশ্লেষণ ও বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করতে হয়। তাও ব্যবস্থাপনা কাজের আওতাধীন ।
৪. কার্যবিভাগের দৃষ্টিকোণ হতে ব্যবস্থাপনার আওতা (Scope of manangement from the view point of division of work) : প্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠুভাবে কার্য পরিচালনার জন্য একে বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করা হয় । এ সকল বিভাগ পরিচালনা সংক্রান্ত কার্যাদিও ব্যবস্থাপনার আওতাধীন। কার্য বিভাগের দৃষ্টিকোণ হতে উৎপাদনধর্মী প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনাকে নানান ভাগে ভাগ করা হয়; যথা-উৎপাদন ব্যবস্থাপনা, ক্রয় ব্যবস্থাপনা, বিক্রয় বা বিপণন ব্যবস্থাপনা, শ্রমিক-কর্মী ব্যবস্থাপনা, অর্থ ব্যবস্থাপনা, অফিস ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি ।
৫. স্তরভেদে ব্যবস্থাপনার আওতা (Scope of manangement from the view point of levels) : ব্যবস্থাপনা, প্রতিষ্ঠানের উচ্চস্তর হতে শ্রমিক-কর্মী তত্ত্বাবধানের স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত । স্তরভেদে ব্যবস্থাপনাকে সর্বোচ্চ স্তর, মধ্যস্তর ও নিম্নস্তর এ সকল ভাগে ভাগ করা হয় । একটা বড় উৎপাদনধর্মী প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনার উপরিস্তরে থাকেন পরিচালকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সাধারণ ব্যবস্থাপক প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ । মধ্যস্তরে বিভাগীয় ব্যবস্থাপক, জোনাল ব্যবস্থাপক, কারখানা ব্যবস্থাপক পদবির ব্যক্তিবর্গ কাজ করেন। নিম্নস্তরে, সুপারভাইজার, মাঠ কর্মকর্তা, ফোরম্যান ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গ সরাসরি কাজ তত্ত্বাবধান করেন। যাদের প্রত্যেকের কাজ ব্যবস্থাপনার আওতাধীন।
ব্যবস্থাপনা চক্র বলতে ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ার অধীন কার্যসমূহের চক্রাকারে আবর্তিত হওয়াকে বুঝায় । ব্যবস্থাপনা হলো কতিপয় কার্যের সমষ্টি। এরূপ কার্যাদি একটি ধারাবাহিক কর্মপ্রক্রিয়ার সৃষ্টি করে । প্রতিষ্ঠান যতদিন চলে ততদিন তা অবিরাম আবর্তিত হতে থাকে। ফলে এরূপ প্রক্রিয়ার সর্বশেষ কাজ আবার পরবর্তী প্রথম কাজের ভিত্তি হিসেবে গণ্য হয়। ব্যবস্থাপনার এরূপ ধারাবাহিক কর্মপ্রক্রিয়া ও অবিরাম আবর্তনকে ব্যবস্থাপনা চক্র নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে ।
ব্যবস্থাপনা একটি প্রক্রিয়া । ফলে তা ধারাবাহিক ও পরস্পর নির্ভরশীল কতিপয় কাজের সমষ্টি । পরিকল্পনা একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লক্ষ্য অর্জনের জন্য নেয়া হয় । এর আলোকে সংগঠন প্রতিষ্ঠা, কর্মীসংস্থান, নির্দেশ প্রদান, যোগাযোগ ও তত্ত্বাবধান, উৎসাহ প্রদান, বিভিন্ন ব্যক্তি ও বিভাগের কাজের মধ্যে সমন্বয়সাধন এবং কাজ বা সময় শেষে নিয়ন্ত্রণ বা সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে । নিয়ন্ত্রণ কাজের মধ্য দিয়ে যে নির্দেশনা বা সুপারিশমালা পাওয়া যায় তার আলোকে আবার নতুন পরিকল্পনা নেয়া হয় । এভাবে প্রতিষ্ঠান যতদিন চলে ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া বা কার্যচক্রও ততদিন স্বাভাবিক নিয়মেই আবর্তিত হতে থাকে ।
নিম্নে চিত্রের সাহায্যে ব্যবস্থাপনা কার্যচক্র প্রদর্শিত হলো :
বিষয়টিকে একটা উদাহরণের সাহায্যে তুলে ধরা যেতে পারে :
ধরা যাক, মি. খান তার শিল্প প্রতিষ্ঠানে নতুন একটা পণ্য তৈরির চিন্তা করছেন। এজন্য লক্ষ্য নির্ধারণপূর্বক করণীয় নির্ধারণ করা হলো । চিন্তার বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় কী কী কাজ করতে হবে এবং প্রতিটা কাজ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা বিভাগের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা কী হবে তা নির্ধারণ করলেন। প্রতিটা কাজের জন্য কোন কোন মানের জনশক্তির প্রয়োজন হবে তাও নির্ধারিত হলো । যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ইত্যাদি কী লাগবে তাও ঠিক করে প্রথমেই মি. খান প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ দিলেন। অতঃপর বস্তুগত উপকরণাদি জোগাড় করে দ্রুত উৎপাদনের কাজে মনোযোগী হলেন । জনশক্তিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়া, কাজ ঠিকমত হচ্ছে কি না তা দেখা ইত্যাদি. কাজে মি. খান ও ব্যবস্থাপকগণ ব্যস্ত সময় কাটালেন । নতুন কাজে সাফল্য আসলে জনশক্তিকে নানান সুযোগ- সুবিধা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হলো । নতুন কাজে উত্তম কর্মপরিবেশ ধরে রাখতে মি. খান খুবই যত্নবান । কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপকগণকে নিয়ে তিনি মাঝে-মধ্যেই বসেন । প্রত্যেকের কাজের অগ্রগতির খোঁজ-খবর নেন । সবাই যাতে একতালে চলে ও সম্মিলিত প্রয়াস জোরদার হয় এজন্য সবাইকে উপদেশ দেন । বছর শেষ- এখন হিসাব করার পালা । যে সকল পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল তার কতভাগ বাস্তবায়িত হয়েছে। দেখা গেল ৮০% বাস্তবায়িত হয়েছে । ২০% কেন বাস্তবায়িত হয়নি তার পর্যালোচনায় কতকগুলো সমস্যা চিহ্নিত হলো । এ সকল সমস্যা দূর করে কাজকে আরও সামনে এগিয়ে নেয়ার জন্য নতুন পরিকল্পনা নিলেন মি. খান।
প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে এবং উপায়-উপাদানের সুষ্ঠু ব্যবহারের লক্ষ্যে পরিকল্পনা, সংগঠন, নির্দেশনা, প্রেষণা, সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ কার্যকে ব্যবস্থাপনা বলে । এ সকল কাজ প্রতিষ্ঠানের উচ্চস্তর হতে নিম্নস্তর পর্যন্ত সকল স্তরেই কম বেশি সম্পাদন করা হয়। তাই ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের কোনো একটি মাত্র স্তরেই সীমাবদ্ধ এ কথা বলা যায় না । নিম্নে ব্যবস্থাপনার স্তরসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. উচ্চ পর্যায়ের ব্যবস্থাপনা (Top level management) : প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ের নির্বাহীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ব্যবস্থাপনাকে উচ্চ পর্যায়ের ব্যবস্থাপনা বলে । প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ও নীতি নির্ধারণ এবং দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য, কৌশল ও পরিকল্পনা প্রণয়নের সঙ্গে ব্যবস্থাপনার উচ্চ পর্যায় সম্পৃক্ত থাকে । কোনো কোম্পানির পরিচালকমণ্ডলী, পরিচালকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান, ম্যানেজিং ডিরেক্টর, সচিব ও ক্ষেত্রবিশেষে জেনারেল ম্যানেজার এ পর্যায়ের ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত।
২. মধ্য পর্যায়ের ব্যবস্থাপনা (Mid-level management) : উচ্চ পর্যায়ে গৃহীত লক্ষ্য, পরিকল্পনা ও নীতি- নির্দেশনা বাস্তবায়নে নিম্ন পর্যায়ের ব্যবস্থাপকগণকে কাজে লাগাতে ব্যবস্থাপনার যে পর্যায় কাজ করে তাকে মধ্য পর্যায়ের ব্যবস্থাপনা বলে । এরূপ পর্যায় উচ্চ ও নিম্ন পর্যায়ের ব্যবস্থাপনার মধ্যে সেতুবন্ধকের ভূমিকা পালন করে । এরূপ পর্যায় উচ্চ পর্যায়ে গৃহীত লক্ষ্য, নীতি, কৌশল ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা গ্রহণ, উপায়-উপকরণাদি সংগঠিতকরণ, পরিচালনা, নেতৃত্ব প্রদান, সমন্বয় এবং নিয়ন্ত্রণ কার্য পরিচালনা করে ।
৩. নিম্ন পর্যায়ের ব্যবস্থাপনা (Lower level or first line management) : মধ্য পর্যায়ের ব্যবস্থাপনা কর্তৃক গৃহীত পরিকল্পনা ও নীতি-কৌশল মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনাকে নিম্ন পর্যায়ের ব্যবস্থাপনা বলে । এ পর্যায়ের ওপরে থাকে মধ্য পর্যায়ের ব্যবস্থাপকগণ ও নিচের দিকে থাকে ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এমন কর্মী বা শ্রমিক। নিচের দিক থেকে ওপর দিকে চিন্তা করলে একেবারে প্রথম সারির ব্যবস্থাপকগণ এ পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। এ পর্যায়কে তত্ত্বাবধায়ন পর্যায় (Supervisory level) নামেও আখ্যায়িত করা হয়।
নিম্নে চিত্রের সাহায্যে ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন স্তর প্রদর্শিত হলো :
ব্যবস্থাপনার কাজকে প্রকৃতিগতভাবে চিন্তা করা (Thinking) ও কাজ করা (Doing) এ দু'ভাগে ভাগ করা . হলে উচ্চ পর্যায়ের ব্যবস্থাপনা অধিক মাত্রায় চিন্তনীয় কাজ এবং নিম্নপর্যায়ের ব্যবস্থাপনা অধিক মাত্রায় সরাসরি কাজের তত্ত্বাবধানের সাথে সম্পৃক্ত থাকে। অন্যদিকে মধ্য পর্যায়ের ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পৃক্ত নির্বাহীগণ মোটামুটিভাবে উভয় ধরনের কর্ম সম্পাদন করে ।
আমাদের সমাজে পেশা বিষয়ে সাধারণ ধারণা খুবই সাদামাটা ধরনের। আমাদের ভোটার তালিকা বা নাগরিকত্ব সনদের ফর্ম পূরণকালে পেশা হিসেবে কৃষিকাজ, চাকরি এমনকি ছাত্র পর্যন্ত লেখা হয়ে থাকে । তাই পেশা কী এ নিয়ে ভুল ধারণা যেমনি রয়েছে তেমনি ব্যবস্থাপনাকে ভিন্ন পেশা হিসেবে দেখা উচিত কি না তা নিয়েও শিক্ষিত মহলে দ্বন্দ্ব বর্তমান। তবে এক কথায় বলা যায়, ব্যবস্থাপনা এখনও পূর্ণাঙ্গ পেশা হিসেবে গণ্য নয় ।
বিশেষায়িত জ্ঞান সম্বলিত কোনো কাজ বা বৃত্তিকে সাধারণ অর্থে পেশা বলে । বিশেষায়িত জ্ঞান বলতে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞানকে বুঝায় । একজন সাধারণ কৃষকের কৃষি বিষয়ক তাত্ত্বিক জ্ঞান থাকে না । কৃষিকাজ করতে করতে তিনি যা শিখেছেন তা নিঃসন্দেহে মূল্যবান কিন্তু তাকে পেশার মানদণ্ডে ফেলা যাবে না । কিন্তু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা গ্রাজ্যুয়েট কৃষি বিষয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞানসমৃদ্ধ । এই জ্ঞানের প্রয়োগ বিষয়ে তিনি পড়াকালীন সময়ে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ! তাই তাকে একজন কৃষিবিদ বলা হয়। একজন হাতুড়ে ডাক্তারকেও গ্রাম-গঞ্জের মানুষ ডাক্তার বলে। কিন্তু যখন কারও পেশা ডাক্তারি বলা হবে তখন ডাক্তারি বিদ্যার ওপর তাত্ত্বিক জ্ঞান বা ডিগ্রি আছে কি না তা দেখতে হবে । এক্ষেত্রে কৃষিবিদ ও ডাক্তারের জ্ঞানকে বিশেষায়িত জ্ঞান বলা হবে । কারণ তাঁরা এ বিষয়ে পরামর্শ দেয়ার ক্ষমতা রাখেন । এভাবে ইঞ্জিনিয়ার, আইনবিদ, চাটার্ড একাউন্টেন্ট ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গও স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিশেষায়িত জ্ঞানের অধিকারী । এরূপ ব্যক্তিবর্গের রাষ্ট্রস্বীকৃত সংঘ বা সমিতি রয়েছে এবং এর সকল সদস্যদের এর সদস্যপদ গ্রহণ করতে হয় । তাদের পেশাগত আচরণ বিধি ও নিয়ম-নির্দেশিকা থাকে এবং যার প্রতি সদস্যগণ দায়বদ্ধ থাকেন । তাই এরূপ জ্ঞানসমৃদ্ধ ব্যক্তিবর্গের কাজকে পেশা হিসেবে গণ্য করা হয় ।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কোনো কাজ বা বৃত্তিকে পেশা হতে হলে তার নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্য থাকা অপরিহার্য:
১. পেশা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সুস্পষ্ট বিশেষায়িত জ্ঞান;
২. পেশাগত বিষয় দেখার জন্য রাষ্ট্র স্বীকৃত প্রতিনিধিমূলক সংঘ বা সংস্থা;
৩. পেশার প্রমাণ হিসেবে উক্ত সংঘ বা সংস্থার সদস্য পদ লাভ ;
৪. পেশাগত আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সংঘ বা সংস্থা কর্তৃক নির্দেশিত বিধি-বিধানের উপস্থিতি;
৫. উক্ত বিধি-বিধান মেনে চলার প্রতি সদস্যদের দৃঢ় অঙ্গীকার এবং
৬. সদস্যবৃন্দের পরামর্শ প্রদানের সক্ষমতা ও ক্ষেত্র বিশেষে পরামর্শক শ্রেণির আবির্ভাব ।
ব্যবস্থাপনা একটি পেশা কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে এক্ষেত্রে উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যাবলির বিদ্যমানত মূল্যায়ন প্রয়োজন । এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, কতকগুলো বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে ব্যবস্থাপনার মিল থাকলেও কতকগুলো ক্ষেত্রে অমিল বিদ্যমান । নিম্নে সামঞ্জস্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ করা হলো :
১. সুসংবদ্ধ জ্ঞানের প্রসার (Expansion of organized knowledge) : বর্তমানকালে বিশ্বজুড়েই ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত জ্ঞানের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সনদ দেওয়া হচ্ছে । সারা বিশ্বেই B.B.A ও M.B.A কোর্স এখন খুবই জনপ্রিয় । বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও এ বিষয়ে ডিপ্লোমা কোর্স প্রদান করছে । এ বিষয়ে গবেষণাকর্ম চলছে সারা বিশ্বজুড়েই । তাই ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ শাস্ত্র হিসেবে বর্তমানে সর্বত্রই প্রতিষ্ঠিত ।
২. বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা সংঘ ও সংস্থা প্রতিষ্ঠা (Establishment of different management association) : উন্নত দেশসমূহে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিভিন্ন সংঘ ও সংস্থা প্রতিষ্ঠা লাভ করছে । যুক্তরাষ্ট্রে আমেরিকান ম্যানেজমেন্ট এসোসিয়েশন, ন্যাশনাল অফিস ম্যানেজমেন্ট এসোসিয়েশন, আমেরিকান ব্যাংকার
এসোসিয়েশনের মতো প্রতিষ্ঠানের নাম এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য । শুধুমাত্র ব্যবস্থাপক বা নির্বাহীগণই এর সদস্য হতে পারেন ।
৩. ব্যবস্থাপকীয় পরামর্শক শ্রেণির আবির্ভাব (Emergence of management consultants) : শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ব্যবস্থাপনা ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরামর্শক সংস্থা ও বিশেষজ্ঞের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শীর্ষ নির্বাহী পদে কর্মরত ছিলেন এমন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকসহ অনেকেই ব্যবস্থাপকীয় পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন। এ ধরনের নিয়োগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত জ্ঞানের বিশেষত্ব বা মর্যাদাই তুলে ধরেছে ।
উপরোক্ত যুক্তিসমূহের মধ্যে অনেকটা সারবত্তা থাকলেও পরিশেষে বলা যায়, ব্যবস্থাপনা এখনও ডাক্তারি বা প্রকৌশলী পেশার ন্যায় বিশেষ পেশার মর্যাদা লাভে সমর্থ হয়নি । ক্ষেত্রবিশেষে ব্যবস্থাপনাকে পেশার মর্যাদায় নিয়ে যাওয়ার সক্রিয় প্রয়াস লক্ষণীয় হলেও বাস্তব অর্থে এখনও ব্যবস্থাপনা সে মর্যাদা লাভ করতে পারেনি । তবে ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব ও প্রভাব যেভাবে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে একদিন তা পেশার মর্যাদা লাভে সমর্থ হবে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় ।
ব্যবস্থাপনার সর্বজনীনতা বলতে সকল ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার আবশ্যকতা বা ব্যবস্থাপনা জ্ঞানের প্রয়োগযোগ্যতাকে বুঝানো হয়ে থাকে। বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ব্যবস্থাপনার আবশ্যকতা যেমনি দৃশ্যমান ছোট প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য। যথোপযুক্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করে সে অনুযায়ী কাজ করলে উভয় ধরনের প্রতিষ্ঠানই লাভবান হতে পারে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠানকেই উপায়-উপকরণাদি সংহতকরণ, কর্মীসংস্থান, নির্দেশনা, প্রেষণা, সমন্বয়, নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি কাজ সম্পাদন করতে হয় । এ কারণেই বলা হয়ে থাকে যে, ‘ব্যবস্থাপনা সর্বজনীন' ।
গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস এর নাম সুবিদিত। প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে গ্রীক সভ্যতাকালে তিনি ব্যবস্থাপনা সর্বজনীন (Management is universal) এ বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন। এ নিয়ে চমৎকার একটা ঘটনার বর্ণনা রয়েছে । তিনি একদিন তাঁর ছাত্র ও ভক্তদের আসরে আলোচনা প্রসঙ্গে বললেন, 'সাবান কারখানার একজন দক্ষ ম্যানেজারকে সেনাধ্যক্ষ বা সামরিক সচিবের দায়িত্ব দেয়া হলে সে দক্ষতার সাথে তা পালন করতে পারবে ।' তখনকার দিনে গ্রীক সমাজে সৈন্যদের ব্যাপক প্রভাব। সেনাকর্মকর্তাগণ সক্রেটিসের এ বক্তব্যকে তাঁদের জন্য অপমানকর মনে করলেন । কারণ তখনকার দিনে সাবান কারখানা নেহায়েতই ছোট ছিল । তার ম্যানেজারের সাথে তাদের তুলনাকে তারা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না । অভিযোগ রাজার দরবারে উত্থাপিত হলো । রাজা সক্রেটিসকে ডেকে তার এরূপ বক্তব্যের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। সক্রেটিস সবার সামনে বললেন, ‘একজন সেনাধ্যক্ষ যুদ্ধের পরিকল্পনা করেন, সৈন্য ও রসদপত্র জোগাড় করে তাকে সংহত করেন, যুদ্ধের নির্দেশ দেন, সৈন্যদের উৎসাহ দেন, যুদ্ধ শেষে জয়-পরাজয় নিয়ে পর্যালোচনা করেন, ভুলভ্রান্তি থাকলে তা সংশোধন করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেন । একজন সাবান কারখানার ম্যানেজার সাবান উৎপাদনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, প্রয়োজনীয় জনশক্তি ও কাঁচামাল সংগ্রহ করেন, কর্মীদের কাজের নির্দেশ দেন, তাদের উৎসাহিত করেন এবং নির্দিষ্ট সময় শেষে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হয়েছে কি না তা দেখে ভুলভ্রান্তি থাকলে তা সংশোধন করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন । তাই ক্ষেত্রগত পার্থক্য থাকলেও ব্যবস্থাপনা একটা সর্বজনীন বিষয় যা সকল সমাজে সর্বকালে সবধরনের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যে কারণে সাবান কারখানার একজন দক্ষ ম্যানেজারও প্রতিরক্ষা সচিবের দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে পালন করতে সক্ষম।' তাঁর বক্তব্যে রাজা সন্তুষ্ট হলেন ।
এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যা ব্যবস্থাপক বা নির্বাহী ভিন্ন চলতে পারে । তাই ব্যবস্থাপনার অস্তিত্ব সর্বক্ষেত্রেই বিদ্যমান । একজন পরিবার প্রধান যেমনি ব্যবস্থাপক তেমনি একজন রাষ্ট্রপ্রধানও এক অর্থে ব্যবস্থাপক । পরিবার প্রধান যদি পরিকল্পিতভাবে পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও উপকরণাদির ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারেন তবে তার পক্ষে লক্ষ্যার্জন সম্ভব হয় । অন্যদিকে একজন রাষ্ট্রপ্রধানকেও তাঁর জনগণ ও সহায়-সম্পদের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করার প্রয়োজন পড়ে ।
ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ার সকল কাজ; যেমন- পরিকল্পনা, সংগঠন, কর্মীসংস্থান, নির্দেশনা, প্রেষণা, সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ যেমনি বড় ধরনের প্রতিষ্ঠানের বেলায় প্রযোজ্য তেমনি একটি সাধারণ প্রতিষ্ঠানেও লক্ষ্যার্জনের জন্য ব্যবস্থাপনার এ সকল কাজ সম্পাদনের প্রয়োজন দেখা দেয় ।
উপরোক্ত আলোচনা হতে প্রতীয়মান হয় যে, দলবদ্ধ যেকোনো কাজ বা প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা একটি অতি অপরিহার্য উপাদান। সকল সমাজেই ব্যবস্থাপনার কাজের ধরন ও প্রকৃতি মোটামুটি একই ধরনের। প্রায়োগিক ক্ষেত্রে চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রতিষ্ঠান ও সমাজভেদে কিছুটা পার্থক্য হলেও যতোই দিন যাচ্ছে এ পার্থক্য ততোই হ্রাস পাচ্ছে । তাই ব্যবস্থাপনা একটি সর্বজনীন বিষয় তা বলা যেতে পারে । এ কারণেই Koontz, "Effective managing is the concern of the corporation president, the hospital Weihrich administrator, the government, first-line superviser, the Boy - Scout leader, the bishop in the church, the baseball manager and the university president.” অর্থাৎ সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা বড় কর্পোরেশনের প্রেসিডেন্ট, হাসপাতালের পরিচালক, সরকারি প্রথম সারির তত্ত্বাবধায়ক, বয়স্কাউট লিডার, গীর্জার পাদ্রী, বেসবল দলের ম্যানেজার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট সবার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ।